নবাব আব্দুল লতিফ
১৮২৬ সালে ফরিদপুর সদর উপজেলার রাজাপুর গ্রামে নবাব আব্দুল লতিফ জন্ম গ্রহণ করেন। আব্দুল লতিফ প্রথম পল্লী পাঠশালায় পাঠ আরম্ভ করেন। অত:পর কলকাতা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও মাইকেল মধুসুদন দত্তের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। মাদ্রাসা থেকে সিনিয়র বৃত্তিসহ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইংরেজী ও পারস্য ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে নবাব আব্দুল লতিফ বাঙগলার শিক্ষা বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। আব্দুল লতিফের যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে তদানীন্তন স্যার ফ্রেডারিক হ্যালিভে তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে নিযুক্ত করেন ১৮৪৯ সালে। অত:পর সরকার তাকে শিয়ালদহের ফৌজদারী আদালতের বিচারভার প্রদান করেন। কয়েক বছর কলকাতায় ম্যাজিস্ট্রেটের পদেও তিনি কাজ করেন। বহু জটিল মোকদ্দমার বিচারকালে তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সর্বপ্রথম মুসলমান সদস্য নিযুক্ত হন। উক্ত পরিষদ সদস্য হিসেবে একাদিক্রমে দশ বছর যোগ্যতার সাথে কাজ করেন। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে আয়কর কমিশনে তিনি একজন সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৬৯ সালে খ্রিষ্টাব্দে সরকার বাহাদুর হুগলী ও কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ পরিদর্শনের ভার তাঁর উপর অর্পন করেন। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে “মহামেডান লিটারারি সোসাইটি” প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকে এ প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় মুসলমান সমাজে এই ধরণের সংগঠন এই প্রথম স্থাপিত হয়। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বড়লাট লরেন্স মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের আগ্রহ দেখে আবদুল লতিফকে স্বর্ণপদক এবং এক প্রস্থ এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটিনিকা নামক বিরাট অভিধান উপহার দেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নবাব উপাধি লাভ করেন। ১৮৮৭ সালে নবাব বাহাদুর উপাধি লাভ করেন সরকারের কাজ থেকে। নবাব আব্দুল লতিফ ছিলেন মিষ্টভাষী, নিরহঙ্কার ওবন্ধুবৎল। বাংলার মুসলিম জাতিকে শিক্ষা, দীক্ষা, জ্ঞান, গরিমা ও সাহিত্যে সচেতন করে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তিনি উপলব্দি করেছিলেন শিক্ষাকে অবহেলা করে ভারতবর্ষের মুসলিম জাতির প্রগতি সম্ভব নয়। তিনি ইংরেজীতে জীবন কথা নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই নবাব আব্দুল লতিফ মৃত্যুবরণ করেন।
১৯০৩ সালে ফরিদপুর সদর উপজেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পল্লীর মাটি ও মানুষের কবি জসীম উদদীনের পিতামহ ছিলেন জমির উদ্দিন মোল্লা, পিতা-আনসার উদ্দিন মোল্লা, মাতা-আমিনা খাতুন। তিনি ফরিদপুর শহর থেকে ১২ মাইল দূরে তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়ী জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে কবি গোবিন্দপুর গ্রামের পাশে শোভারামপুর গ্রামে চৌধুরী বাড়ীতে অম্বিকা মাষ্টারের পাঠশালায় পড়ালেখা শুরু করেন। পরে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে কবির পিতা মরহুম মৌলবী আনসার উদ্দিন আহমেদ শিক্ষকতা করতেন। চতুর্থ শ্রেনী পাশ করে কবি ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন। কবি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন অসহযোগ আন্দোলনের ধুম। স্কুল কলেজ ছেড়ে ছাত্ররা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমে পড়েছে। কবিও স্কুল ত্যাগ করে অনেক কষ্ট করে কলকাতায় গেলেন। কলকাতার কিশোর কবি নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করেন। নজরুল ইসলামকে একটি কবিতার খাতাও দেখতে দেন। নজরুল আগ্রহ সহকারে খাতাটি নেন। নজরুলের যে কবিতাগুলো ভাল লেগেছিল সেগুলো দাগ দিয়ে দেন এবং এগুলোর নকল পাঠিয়ে দিতে বলেন। নজরুলের চেষ্টায় কবির কয়েকটি কবিতা কলকাতার মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়। দেশে ফিরে কবি আবার স্কুলে যেতে লাগলেন। নজরুলের কাছে তিনি কবিতা পাঠিয়ে সুদীর্ঘ পত্র লিখতেন। নজরুলের কাছ থেকে জবাবও পেতেন। কিছুদিন পরে মোসলেম ভারত পত্রিকার যে সংখ্যায় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যায় মিলন গান নামক জসিম উদদীনেরও একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাধনা পত্রিকায়ও দুতিনটি কবিতা ছাপা হয়। এর সবকয়টাই নজরুলের চেষ্টায় প্রকাশ পেয়েছিল। কবি ১৯২১ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্টিকুলেশন পাশ করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। কবির বিখ্যাত কবর কবিতাটি এসময়েই রচিত হয়েছে। এসময় কবি গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে গেলেন। গ্রামের লোকদের সুখ দু:খের চিত্র তিনি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুললেন। এরপর কলকাতায় ডা: শহীদুল্লাহর সঙ্গে কবির আলাপ হল। এরকিছুদিন পর কল্লোল পত্রিকায় তার ঐতিহাসিক কবর কবিতাটি ছাপা হলো। তারপর থেকে দেশের বড় বড় মাসিক পত্রিকা হতে তার লেখা চাওয়া হয়েছিল। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আই.এ এবং ১৯২৯ সালে বি.এ পাশ করেন। ১৯৩১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী কলেজে সহকারী গবেষক পদে যোগদান করেন ১৯৩৩ সালে। এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন । এরপর তিনি ১৯৩৯ সালে মমতাজ বেগমকে বিয়ে করেন। তার ৪ ছেলে এবং ২ মেয়ে। কামাল আনোয়ার, ড. জামাল আনোয়ার, ফিরোজ আনোয়ার, খুরশীদ আনোয়ার, হাসনা মওদুদ ও আসমা তৌফিক। ছয় বছর অধ্যাপনা করার পর ১৯৪৪ সালে তৎকালীন ভারত সরকারের অধীন সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে সরকারি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মনিত ডি.লিট উপাধি এবং ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। রাখালী কবির প্রথম কাব্য গ্রন্থ। জসীম উদদীন কবিতা, গান, ভ্রমন কাহিনী, স্মৃতি কথা, হাসির গল্প, গীতিনাট্য, রুপক নাট্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। কবির অনেকগুলি বই ইংরেজী, ফারসী, চেক, আরবী, রুশ প্রভৃতি ভাষায় অনুদিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাখালী, নকসী কাঁথার মাঠ, বালুচর, ধানক্ষেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রঙিলা নায়ের মাঝি, এক পয়সার বাঁশী, চলো মুসাফির, হলদে পরীর দেশে, মাটির কান্না, বেদের মেয়ে, মধুমালা, ডালিমকুমার, পল্লী বধু, গাঙের পাড়, জীবন কথা, জারী গান, যে দেশে মানুষ বড়, বোবা কাহিনী ইত্যাদি । শহরের যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে যখনই তিমি অম্বিকাপুর নিজ গ্রামে আসতেন তখনই আবার আনন্দে মেতে উঠতেন। পল্লীকবি অম্বিকাপুরে আসলে এ গাঁ ও গাঁও গিয়ে পরিচিত সবার খোঁজ খবর রাখতেন। কবির আগমনে সমস্ত গ্রামে সাড়া পড়ে যেত। বিভিন্ন অভিযোগ এবং সমস্যা নিয়ে তারা আসতেন কবির কাছে। ১৯৭০ সালে কবি তার নিজ এলাকা অম্বিকাপুরে তাঁর পিতার নামে আনসার উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করার পর তার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে স্কুলটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।পল্লি কবি জসিম উদ্দিন ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ
হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংস্কারক। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার শ্যামাইল গ্রামে ১৭৮১ সালে জম্ম গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গদেশে ফরায়েজী আন্দোলন এর প্রবর্তক ছিলেন । তিনি ওহাবী মতে দীক্ষিত হয়ে ফরায়েজী জামাত সৃষ্টি করে আন্দোলন শুরু করেন যা ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে । হাজী শরীয়ত উল্লাহর পুত্র মহসীন উদ্দিন আহমেদ ইতিহাসে পীর দুদু মিয়া নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ । হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৮৪০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র পীর দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলন এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ।
আম্বিকাচরণ মজুমদার
আম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৫১ সালে ৬ জানুয়ারী বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় জম্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৮৫৭ সালে জেনালের এসেম্বলিজ ইন্সিষ্টিটিউট থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন । পরে বি এল পাশ করে ফরিদপুর বারে আইন ব্যবসায় যোগদান করেন। কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আম্বিকাচরণ মজুমদারের সভাপতিত্বে ফরিদপুরে ১৯০৫ সালের জানুয়ালী মাসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। আম্বিকাচরণ মজুমদারের নেতৃত্বে ফরিদপুরের উকিল ও মোক্তারগণ স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। জেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । আম্বিকাচরণ মজুমদারই হচ্ছেন রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি কংগ্রেসের ৩১ তম সভাপতি ছিলেন । ১৯২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কংগ্রেসের এই প্রখ্যাত নেতা মৃত্যুবরণ করেন।
সনেট কবি সূফী মোতাহার হোসেন
সনেট কবি সূফী মোতাহার হোসেন ১৯০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার ভবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মোহাম্মদ হাশিম। মায়ের নাম তৈয়বতননেছা খাতুন। মোতাহার হোসেনের আরও একভাই এবং ছোট একটি বোন ছিল। বোনের নাম ছিল সুফিয়া আখতার বানু। একমাত্র ছোট বোনটি মাত্র ১০ বছর বয়সে মারা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য জগতে কবি সূফী মোতাহার হোসেন এক জ্যোতিষ্কের মতো আবির্ভূত হন। রবীন্দ্র-নজরুল যুগের হলেও তাঁদের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে তিনি নিজস্ব রচনাশৈলী ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি করেছিলেন। পিতাঃ মোহাম্মদ হাশিম বেঙ্গল পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। পিতার কর্মস্থলের সুবাধে বিভিন্ন জেলার স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। সে সূত্রে কুমিল্লা জিলা স্কুলে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯২০ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এফ এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩১ সালে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির, সাহিত্যিক আবুল ফজল প্রমুখ কবির সহপাঠি ছিলেন। এই সময়ে কবি কিছু ছোট গল্প ঢাকার বাংলার বানী, কলকাতার আত্মশক্তি, মোয়াজ্জিন, সওগাত প্রভৃতি পত্রিকায় ছাপা হয়। এই সময়ে তিনি পূর্ব বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের পুরোধা কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী আবুল হোসেন, ড. কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকার পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে কাজী নজরুলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। ইতিমধ্যেই তিনি কিছু কবিতা লেখা শুরু করেন। পরের বছর কাজী নজরুল ইসলাম ফরিদপুর এলে তাকে একটি কবিতা দেখান। নজরুল ইসলাম এই কবিতার একটি শব্দ পরিবর্তন করে দেন এবং পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতে বলেন। কবিতাটি ঢাকার শান্তি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটাই কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতা । এরপর অধ্যাপক শ্রীপরিমল ঘোষ সম্পাদিত দিপীকা পত্রিকায় কবির কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। দিপীকা যুগেই সনেটের সূচনা। এ সময়ে তিনি সমালোচক কবি মোহতিতলাল মজুমদারকে দুটি সনেট দেখান। এতে মোহিতলাল মজুমদার খুবই মুগ্ধ হন। কাজী নজরুল ইসলাম ও মোহিতলাল মজুমদারের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার ফলে তিনি কাব্য চর্চায় প্রেরণা লাভ করেন। মূলত সনেট রচনার মাধ্যমেই তাঁর কবি-প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এরপর কবির সনেট কবিতা কলকাতার উপাসনা, মাসিক মোহাম্মাদী, সওগাত-বিচিত্রা, পরিচয়, কাশ্মীর, উত্তরা প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪০ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত সনেট দিনান্তে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা কাব্য পরিচয়ে সংকলিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯২৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রীর নাম সৈয়দা আছিয়া খানম। সংসার জীবনে প্রবেশ করার কয়েক মাস পরেই তার পিতা পরলোকগমন করেন। সূফী মোতাহার হোসেনের চার সন্তান। তারা হলেন গুলফাম শাহানা, সূফী আবদুল্লাহ আল মামুন, সূফী ওবায়দুল্লাহ আল মোস্তানছির এবং নীলুফার বানু। স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ফরিদপুর জজকোর্টে চাকুরী জীবন শুরু করেন। দুই বছর চাকুরী করার পর নিউরেস্থিনিয়া ও ডিসপেপশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ১২ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। রোগমুক্তির পর প্রথমে স্থানীয় ময়েজউদ্দিন হাই স্কুলে ও পরে ঈশান স্কুলে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। ১৯৬০ সাল থেকে আর্থিক সমস্যার কারণে কবিকে পাঁচ মাইল দূরবর্তী গ্রামের বাড়ী থেকে স্কুলে শিক্ষকতা করতে হয়। ফলে অত্যাধিক পরিশ্রম ও মানসিক উদ্বিগ্নতার জন্য কবির লেখা বন্ধ থাকে। সনেটকার সূফী মোতাহার হোসেনের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন আমাদের মানসিক দৈন্যেরই পরিচয়। অনেক সময়ে কবিকে বলতে শোনা যেত ‘যদি শহরে একটা ঘরের ব্যবস্থা করিতে পারিতাম তবে আবারলিখিতে পারতাম। প্রভাতে বাতি ধরাইয়া বাসি ভাত খাইয়া স্কুলের দিকে ছুট দেই, যখন ফিরি তখন সন্ধ্যা পার হইয়া হইয়াছে। তারপর বাজারের ব্যাগ তো আছেই-কবিতা থাকে কোথায় ।’ অথচ কারো বিরুদ্ধে নালিশ নেই, অভিযোগ নেই । আপন ভোলা সরল প্রকৃতির অনাড়ম্বর মানুষটি আর্থিক সমস্যার কারণে সময় মত প্রকাশ পায়নি । অবশেষে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ সূফী মোতাহার হোসেন সনেট প্রকাশনা সংসদ কর্তৃক সাদামাটা ভাবে কবির প্রচুর সনেটের মাত্র একশতটি সনেট চয়ণ করে ’সনেট সংকলন’ প্রথম প্রকাশ করা হয়। এটিই ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত শ্রেষ্ট কবিতা সংকলন হিসেব স্বীকৃতি পায় এবং কবিকে এই সংকলনের জন্য আদমজী পুরস্কার দেওয়া হয় । রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত 'বাংলা কাব্য পরিচয়' বইয়ে মোতাহার হোসেনের 'দিগন্ত' সনেটটি অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর প্রথম কাব্য-সনেট সংকলন (১৯৬৫), পরে সনেট সঞ্চয়ন (১৯৬৬) ও সনেটমালা (১৯৭০) প্রকাশিত হয়। প্রেম ও প্রকৃতি তাঁর সনেটের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তিনি ১৯৬৫ সালে 'আদমজী পুরস্কার', ১৯৭০ সালে 'প্রেসিডেন্ট পুরস্কার' এবং ১৯৭৪ সালে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার' লাভ করেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকর মৃনাল সেন
ভারতীয় বাংলা চলচিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী মৃনাল সেন ১৯২৩ সালে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জীবন ধর্মী পরিচালক হিসাবে খ্যাত। একজন বাস্তববাদী লেখকের ন্যায় জীবনের ডকুমেন্টারি তার ছবির প্রতিপাদ্য বিষয়। মূলত তিনি একজন মার্কসবাদী ব্যাক্তিত্ব। ছাত্র অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদেন। তিনি কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর তিনি একজন সাংবাদিক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একটি ঔষুধ কোম্পানীতে মাকেটিংএর কাজ করেন। এ সময় তিনি চলচিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং প্রখমে তিনি চলচিত্রের একজন সাউন্ডম্যান এর কাজ শুরু করেন। তারপর আস্তে আস্তে তিনি চলচিত্র পরিচালনা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ‘রাতভোর’ নামে একটি চলিচিত্র নির্মান করেন। ছবিটা দর্শক মহলে তেমন একটা প্রশংসা পায়নি। এরপর তিনি নির্মাণ করলেন তার দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে। এছবিটা স্থানীয়ভাবে বেশ সমাদৃত হয়। এরপর আস্তে আস্তে নির্মান করলেন ভুবন সোম, ক্যালকাটা, পদাতিক যা তাকে একজন আন্তর্জাতিক পরিচালকের খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। তিনি আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। বাংলা ছাড়াও তিনি হিন্দি ও তেলেগু ভাষায় চলচিত্র নির্মান করেন। ১৯৮১ সালে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ভারত সরকার তাকে পদ্মভুষন পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বের তিনি ভারতে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রখ্যাত অভিনেতা পিযুষ বন্দোপাধ্যায়
পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী অভিনেতা। পাশাপাশি তিনি একজন নাট্যকার, আবৃত্তিকার ও সংগঠক। ১৯৮০-র দশকের শুরুতে সকাল সন্ধ্যা নামক টিভি সিরিয়ালে ‘শাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পান। তিনি বিটিভির মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শুরু মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আগামী দিয়ে। এরপর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাত্তরের যীশু চলচ্চিত্রে পাদ্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এছাড়া ২০১১ সালের আরও দুটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আমার বন্ধু রাশেদ ও গেরিলায় অভিনয় করেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে আমার বন্ধু রাশেদ নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম এবং গেরিলা নির্মাণ করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- আগামী, সে, মহামিলন, উত্তরের খেপ, কিত্তনখোলা, মেঘলা আকাশ, আধিয়ার, আমার আছে জল, মৃত্তিকা মায়া, আমি শুধু চেয়েছি তোমায় ও বুনো হাঁস।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বিটিভির মহাপরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপত্র পান। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড তুলে দিয়ে গ্রেডিং সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা করেন।
পাটের জীবন রহস্য উম্মোচনকারী বিজ্ঞানী প্রফেসর মাকসুদুল আলম
১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্ম নেয়া মাকসুদুল আলমের বাবা দলিলউদ্দন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। স্বামীকে হারিয়ে চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয় মাকসুদুলের মা লিরিয়ান আহমেদকে। তবে তার চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মাকসুদুল রাশিয়ায় চলে যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন। বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করে আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছরের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি গুরুত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
গত বছরের ১৮ আগস্ট মাকসুদুলকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় সাফল্যের খবর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আসে দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর। জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। গবেষণাগারে এই জিনবিন্যাস অদলবদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী এর নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম পানি লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব-জাল্বানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে। এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের এই গবেষক। পেঁপে নিয়ে তার কাজের বিষয়ে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
ডাঃ মোঃ জাহেদ
ব্যক্তিজীবনঃ
ডাঃ মোহাম্মদ জাহেদের জন্ম ১ লা মার্চ ১৯২৮ সালে ফরিদপুর শহরতলীর ঢোল সমুদ্র পাড়ে আলিয়াবাদ ইউনিয়নের বিলমামুদপুর গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ ইছহাক ডাক বিভাগের পোষ্ট মাষ্টার ছিলেন। মাতা হুরমতুন নেসা গৃহিনী ছিলেন। আবদুস সালাম ও বদরউদ্দিন নামে আরও দুই ভাই এবং সুফিয়া বেগম নামে তাঁর এক বোন রয়েছে । তিনি ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম ফাতেমা বেগম। সালাহউদ্দিন ফরিদ, মোহাম্মদ ফুয়াদ, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ও সাইফুদ্দিন মনা নামে ৪ জন পুত্র সন্তান এবং নাদিরা, মুনিরা ও হুমায়রা নামে ৩ জন কন্যা সন্তান রয়েছে।
শিক্ষা জীবনঃ
নিজগ্রাম আলিয়াবাদে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ডাঃ মোহাম্মদ জাহেদ ১৯৪৪ সালে ফরিদপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ১৯৪৮ সালে । ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলেন যে সেখানে বাংলা নাটক নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আন্দোলনে নামলেন এবং তাদের তীব্র আন্দোলনের ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু হলো। আর এই আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । আর তখন থেকেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসৈনিক । ১৯৫২-৫৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি মওলানা ভাসানীর অনুপ্রেরণায় দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন।
কর্মজীবন
১৯৫৮ সালে চুয়াডাঙ্গা মহকুমা মেডিকেল অফিসার পদে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে সরকারি চাকুরী ইস্তফা দিয়ে নিজ জেলা ফরিদপুরে ফিরে আসেন। ফরিদপুর শহরের চকবাজার স্ট্যান্ডার্ড ফার্মেসীতে, পরে আলীপুর ভাড়া বাসায় অতঃপর হরি গোবিন্দ সাহার টিনের ঘরে এবং সবশেষে আলীপুর বাসায় চেম্বার চেম্বার করে প্রাকটিস করেন। ডাক্তারী পেশার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে ফ্রি স্যাম্পল প্রদানের কাজ চালিয়ে যান।
১৯৮০ সালে হাসান নামের এক চার বছরের শিশু কৃমির ঔষুধের অভাবে অন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি তাকে ভীষন বেদনা দেয়। এরপর তিনি ডাঃ ননী গোপাল সাহা, ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক, ডাঃ আবদুস সালাম চৌধুরী, রকিব উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক এম এ সামাদ, অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ সাহা, কামরুজ্জামান খান জাসু প্রমূখ ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে এই বছরের ২রা মার্চ সানডে ফ্রি ক্লিনিক নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা বর্তমানে একটি পূর্নাঙ্গ ডাঃ জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে । ১৯৮০ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি ফরিদপুর জেলা শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
রেডক্রস সানডে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করার পর ১৯৮১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শিশু চিকিৎসা কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন শিশু ভবন এর ভিত্তি স্থাপন করেন। এরপর ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এই শিশু ভবনটি উদ্ধোধন করে তৎকালীন সামরিক শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ।
এরপর তিনি ১৯৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ডায়বেটিক সমিতি এর ফরিদপুর জেলা শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তার সমাজ কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদ পুরস্কার-১৯৮৮ প্রদান করে। এরপর ১৯৯৬ সালে জসীম ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক(মরণোত্তর) লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে বিএমএ ফরিদপুর শাখা তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে।
ফরিদপুরে সমাজসেবায় তাঁর রয়েছে বিশাল অবদান। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিকিৎসা পেশায় ও সমাজসেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ফরিদপুরে স্বাস্থ্য ও সমাজ সেবায় বিশেষ ভূমিকা পালন করায় ফরিদপুর বাসী তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ১৯৯২ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
কবি হুমায়ুন কবির
কবি হুমায়ুন কবির ১৯০৬ সালে ফরিদপুর সদর উপজেলার কোমরপুর গ্রাম জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক ও রাজনীতিবিদ। পিতা ছিলেন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর কবির উদ্দিন আহম্মেদ। ১৯২২ সালে নওগাঁ কেবি স্কুল থেকে ইংরেজীতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে লেটারসহ তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন এবং মাস্টার্স পরীক্ষায় তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। এরপর তিনি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একসেটর কলেজে ভর্তি হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ভারত ফিরে এসে তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সরকারি উচ্চ পদস্থ চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির টিকিট নিয়ে মুসলিম লীগের তমিজ উদ্দিন খানের সাথে ফরিদপুর আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে হুমায়ূন কবির পরাজিত হন। ১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারী হিসাবে বৃটিশ ক্যাবিনেটে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। তিনি একসময় নিখিল ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সু-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী হিসাবে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। দর্শন সাহিত্য ও সমাজ তত্বের উপর বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় বহুমূল্যাবান গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। কলকাতা থেকে ‘চতুরঙ্গ’ নামক একটি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত। তাঁর রচিত ‘বাঙলার কাব্য’ ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সংক্রান্ত একটি মূল্যবান আলোচনা গ্রন্থ। হুমাযুন কবিরের প্রকাশিত গ্রন্থাবলীঃ- পদ্মা, মুসাদ্দাসই হালী, বাংলার কাব্য, মার্কসবাদ, নদী ও নারী ইত্যাদি। ১৯৬৯ সালে ফরিদপুর পৌরসভার ১০০ শত বছর পূর্তিতে তিনি এবং তাঁর পরিবার মিলে তাদের পৈত্রিক বাড়ী ঐতিহাসিক কবির বাগ যেটি বর্তমানের সাজেদা কবির উদ্দিন পৌর বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত সেটি নারী শিক্ষা সম্প্রসারনে ফরিদপুর পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রখ্যাত বাউল শিল্পী হাজেরা বিবি
১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণকারী হাজেরা বিবি বিবাহ সূত্রে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বিয়ের ৩ মাস পরেই বিধবা হন। সততা, উদারতা ও নিষ্ঠার প্রবল আত্মবিশ্বাস দিয়ে হাজেরা বিবি পরাভূত করেন সকল বৈরিতা ও প্রতিবন্ধকতা। অর্জন করেন আত্মার প্রশান্তি ও চিত্তের আরাম। তাঁর ক্রমাগত সংগ্রামের রোজনামচা তুলে আনা বড় দূরহ। মানুষ হিসেবে হাজেরা বিবি ছিলেন অতিসজ্জন,পরোপকারী ও উদার। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে টের পাওয়া যেত তিনি তাঁর গানের মতোই সুন্দর সরল ও গভীর ছিলেন। হাজেরা বিবির সংসার জীবন, গায়কী সফলতা, ধর্মান্তরিত হওয়াসহ সবকিছুতেই ছিল কবি জসীমউদ্ দীনের উৎসাহ সহযোগিতা ও প্রেরণা । পল্লীকবি জসীম উদদীনের মাধ্যমেই সংগীত জগতে তিনি স্থায়ী আসন করে নেন । জসীম উদদীন রচিত পল্লীগীতি, মারফতি, মুর্শিদী, বিচার ও জারী গান গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর পাকিস্থান রেডিওতে শিল্পী হিসাবে গান করেছেন। তার নিচের রচিত গান গ্রাম বাংলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল। অল্প বয়সেই তিনি সংগীত জগতে ধূমকেতুর মত আর্বিভূত হয়েছেন। তার গানের স্বীকৃতি স্বরুপ একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ফরিদপুর লালন পরিষদ ও সংগীত শিল্পী কল্যাণ সমিতির সদস্য ছিলেন। ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস